ওষুধ ছাড়াই ভালো থাকুন
বিশ্বায়নের
প্রভাবে আমরা প্রকৃতিসম্মত জীবনযাত্রা
থেকে দূরে সরে যাচ্ছি দিনকে দিন। কৃত্রিম, অসুস্থ ও ক্ষতিকর জীবনধারণে যুক্ত হয়ে যাচ্ছি। এর
ফলে আমাদের শরীর ও মনে নানান নেতিবাচক দশা তৈরি
হচ্ছে। অথচ স্বাভাবিক উপায়ে খুব সহজেই সুস্থ, সুন্দর ও সুখী জীবন উপভোগ করা সম্ভব। জীবনের
ধাঁচ বা লাইফস্টাইল পরিবর্তন করলে বার্ধক্য
ঠেকিয়ে সতেজ, সুন্দর
ও সুখী জীবন পাওয়া যায়।
আদর্শ খাদ্য
স্বাস্থ্যকর খাবার সুস্থ জীবনের জন্য
অপরিহার্য জানি সবাই। কিন্তু মানি কয়জন? খাবার হতে হবে কম ক্যালরিযুক্ত; কিন্তু বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ। উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, আর্থ্রাইটিস ও ক্যান্সারজাতীয়
প্রাণঘাতী রোগ থেকে
বাঁচতে হলে বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে ঘি, বাটার, ডালডা, চর্বি বা প্রচুর তেলসমৃদ্ধ পোলাও, রোস্ট, বিরিয়ানি, খাসি ও গরুর গোশত খাওয়া কমিয়ে দিন। অনুষ্ঠানগুলোতে
যেসব খাবার পরিবেশিত হয়, তা
সুস্বাদু হলেও স্বাস্থ্যসম্মত
নয় একেবারেই। বিশেষ করে ৪০ থেকে ৪৫ ঊর্ধ্ব ব্যক্তির
জন্য জাঙ্কফুড খুবই
বিপজ্জনক খাবার। এসব খাবারে পুষ্টি কম, চর্বি বেশি। জাঙ্কফুড বা ফাস্টফুড যে নামেই ডাকুন না
কেন এসব খাবার খেতে যত মজাদারই হোক শরীরের জন্য
ভালো নয় মোটেই। এতে আরো রয়েছে অতিরিক্ত লবণ, চিনি, মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (টেস্টিং সল্ট) ও
টারট্রাজিনজাতীয় (কোমল পানীয়, চিপস
ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়)
বিতর্কিত খাদ্যোপকরণ। জৈব খাবার দেহের জন্য আদর্শ।
কীটনাশক
এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াই যেসব খাদ্য উৎপাদন
করা হয় সেগুলোই
অর্গানিক বা জৈব খাদ্য। খাবারে কম করে হলেও অর্ধেক জৈব
শাকসবজি ও ফলমূল থাকা
উচিত। বাকি খাদ্যের মধ্যে থাকতে হবে জৈব ভুসিসমৃদ্ধ শস্য, বাদাম, বিভিন্ন ধরনের বীজ ও তেল। সবচেয়ে
ভালো তেল হলো তিসি ও জলপাইয়ের তেল। তবে অন্যান্য তেলের তুলনায় সুলভ
ও সহজলভ্য বলে সয়াবিন তেলই বেশি খাওয়া হয়। আর সালাদ হতে হবে খাবারের একটি
অপরিহার্য অংশ।
পরিশোধিত
শর্করা, চিনি, সাদা রুটি, ময়দা, পেস্তা, কেক, কুকিজ, পিজ ও পেস্ট্রি বর্জন করুন। অঙ্কুরিত
এবং সম্পূর্ণ পেস্তা বা আটা (অর্থাৎ
যে ভাঙানো গম থেকে কিছুই
ঝেড়ে ফেলা বা ছেঁটে ফেলা হয়নি) খাদ্য তালিকায়
অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত জরুরি। খাসি
এবং গরুর গোশত কম খাওয়া ভালো। এর মধ্যে থাকা চর্বি হৃদরোগ সৃষ্টির কারণ। প্রোটিন
হিসেবে মাছ ও মুরগির গোশত ভালো। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড শরীরের জন্য
বিশেষ উপকারী। কাঁচা লবণ খাওয়া কমিয়ে দেয়া দরকার।
অর্গানিক
ডিম, দুধ ও দই
স্বাস্থ্যকর খাবার। এসবের ভিটামিন-সি, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন-ই, সেলেনিয়াম শরীরের জন্য বিশেষ
উপকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের
সবচেয়ে ভালো উৎস ফলমূল, শাকসবজি ও সবুজ চা। ওষুধ
কোম্পানি উৎপাদিত ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের
চেয়ে প্রাকৃতিক ভিটামিন ও
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অনেক বেশি কার্যকর ও সস্তা।
ব্যায়াম করুন
প্রতিদিন
দুই মাইল (তিন কিলোমিটার) হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রথম
দিকে অল্প দূরত্ব টার্গেট
করে হাঁটা শুরু করুন। আস্তে আস্তে দূরত্ব ও হাঁটার গতি এমন পর্যায়ে বাড়ানো উচিত, যাতে হৃদস্পন্দনও বাড়ে। হাঁটার
জন্য নরম ও হালকা-পাতলা
জুতা ব্যবহার করলে হাঁটায় গতি ও আরাম পাওয়া যায়। বাইরে খোলামেলা জায়গায় দূষণমুক্ত বাতাস
ও সূর্যের আলোতে হাঁটার উপকারিতা বেশি। এতে সারা দিনের শারীরিক ও মানসিক
ক্লান্তি, অবসাদ ও
দুশ্চিন্তা দূর হবে। ব্যায়াম
করলে রাতের ঘুম ভালো হয়। হাঁটা ছাড়াও সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা অথবা জিমনেশিয়ামে ব্যায়াম করা
যেতে পারে। ব্যায়াম শুরু করার আগে অবশ্যই একজন ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট বা
ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন।
ওজন কমান
ক্যান্ডি, আইসক্রিম, প্রচুর চিনিসমৃদ্ধ খাবার, কোমলপানীয় পান, তেল ও চর্বিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার কারণে মানুষের ওজন
বেড়ে যাচ্ছে। শরীরের মাত্রাতিরিক্ত ওজনের সঙ্গে হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসজাতীয় বহু রোগের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এসব
ভয়ঙ্কর মরণঘাতী রোগের কথা ভেবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা স্থূলকায় লোকদের ওজন কমিয়ে
স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অতিরিক্ত
চর্বি ও ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার শরীরের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। স্থূলকায়
লোকদের শরীরের শিরা-উপশিরার অভ্যন্তরীণ দেয়ালে
কোলেস্টেরল, লিপিড
বা চর্বিজাতীয় দ্রব্য এবং লাইপোফেজ পুঞ্জীভূত হওয়ার কারণে শিরা মোটা হয়ে যায় এবং সমপ্রসারণ-সংকোচন ক্ষমতা বিলুপ্ত
হয়। ফলে উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত
হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।
পানিই জীবন
শরীরের ৭২ শতাংশই পানি। এমনকি
হাড়ের এক-চতুর্থাংশ, পেশির
তিন-চতুর্থাংশ এবং মস্তিষ্কের
৮৫ শতাংশও পানি। রক্ত ও ফুসফুসের ৮০ শতাংশই পানি দিয়ে
গঠিত। জীবনের
জন্য অক্সিজেনের পরে পানির স্থান। অনেকে মনে করেন কফি, চা ও সোডা থেকে তারা পর্যাপ্ত পানি আহরণ
করেন। তা খানিকটা ঠিক, তবে
চা ও কফিতে রয়েছে ক্যাফেইন, যা সাধারণত ডাইইউরেটিক হিসেবে
কাজ করে। ডাইইউরেটিকের কাজ হলো শরীর থেকে পানি বের করে দেয়া। শরীরের
ওজনের সঙ্গে পানি পানের পরিমাণের একটি সুসম্পর্ক
রয়েছে। কারো শরীরের ওজন যদি ১২০ পাউন্ড হয়, তার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে সাত-আট গ্লাসের পানি
দরকার। পরীক্ষায় দেখা গেছে, পানিস্বল্পতার কারণে শরীরে শক্তি তৈরি হতে পারে
না। বেশি পানি পান করলে শরীর থেকে অতিসহজে বর্জ্য পরিষ্কার হয়ে যায় এবং
কোষে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি ঢুকতে পারে। প্রতিদিন আট থেকে ১০ গ্লাস পানি
পান করলে ৮০ শতাংশ ভুক্তভোগীর পিঠ ও গিঁটের
ব্যথা সেরে যায়। শরীরে ২ শতাংশ
পানিস্বল্পতা দেখা দিলে স্মৃতিশক্তি সাময়িক
লোপ পেতে পারে। প্রতিদিন পাঁচ গ্লাস
পানি পান করলে মলাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি
৪৫ শতাংশ, স্তন
ক্যান্সারের ঝুঁকি ৭৯ শতাংশ এবং ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ কমে যায়।
ধূমপান ছাড়ুন
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অভ্যাস, জানেন সবাই। ধূমপান
করলে শরীরে অসংখ্য রোগের
উৎপত্তি হয়। বেশির
ভাগ ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য ধূমপানকে দায়ী করা হয়।
পর্যাপ্ত ঘুমান
পরিমিত ঘুমের অভাবে দেহে শক্তি উৎপাদন, গ্লুকোজ মেটাবলিজম কমে যায় এবং
বয়োবৃদ্ধি বা এইজিং
প্রক্রিয়া বেড়ে যায়। শরীরে শক্তি সংরক্ষণ, কোষপুঞ্জ তৈরি ও মেরামত, শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা
পুনর্গঠন, মস্তিষ্কে
কোষের ধ্বংসাবশেষ থেকে
পরিষ্কার রাখার জন্য পর্যাপ্ত ও নিরুপদ্রব ঘুমের প্রয়োজন। শরীর
তার ক্ষয়পূরণ ও মেরামত
করে ঘুমের ডেল্টা পর্যায়ে যা সকালের গভীর ঘুমের সময় সংঘটিত হয়ে থাকে। ভরা পেটে ঘুমাতে
গেলে ভালো ঘুম হয় না। আর ঘুমানোর কাছাকাছি সময়ে রাতের খাবার খেলে
সর্বোচ্চ পরিমাণে গ্রোথ হরমোন নিঃসরিত হয় না। রাতের
বেলায় বেশি পানি পান করলে বারবার টয়লেটে যেতে হয় বলে ঘুমের বিঘ্ন ঘটে। এটাও
স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।
উপকারী রোদ
সূর্যালোক উপভোগ করুন। কারণ
সূর্যালোক সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যা ছাড়া
শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হয় না। আর ভিটামিন ডির
ঘাটতি হলে শরীরে ক্যালসিয়ামের
বিশ্লেষণে বিঘ্ন ঘটে। ক্যালসিয়াম শরীরের জন্য খুব
প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ। প্রতিদিন
অন্তত ৩০ মিনিট সূর্যস্নান করা দরকার।
ওষুধেও বিপদ
ওষুধ যেমন রোগ সারায়, তেমনি রোগও সৃষ্টি করতে পারে। ওষুধ
সাধারণ ভোগ্যপণ্যের মতো
কোনো পণ্য নয়। সুতরাং অপ্রয়োজনে, নিজের খেয়ালমতো কিংবা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ গ্রহণ
করা উচিত নয়।
আত্মনিয়ন্ত্রণ
শরীর কেবল রক্ত-মাংসে গড়া কোনো বস্তু নয়, মন এবং আত্মা এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবেগ-অনুভূতি মানুষের শরীরের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলে। বস্তুজগতে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য, অসূয়া বা ঈর্ষা ও প্রতিহিংসা আমাদের দুঃখ, কষ্ট, অশান্তি, অসুস্থতা ও ধ্বংসের মূল কারণ। বদ অভ্যাস থেকে নিজেকে দূরে রেখে পরম স্বর্গসুখের স্বাদ লাভ করা যায়।
শরীর কেবল রক্ত-মাংসে গড়া কোনো বস্তু নয়, মন এবং আত্মা এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবেগ-অনুভূতি মানুষের শরীরের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলে। বস্তুজগতে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য, অসূয়া বা ঈর্ষা ও প্রতিহিংসা আমাদের দুঃখ, কষ্ট, অশান্তি, অসুস্থতা ও ধ্বংসের মূল কারণ। বদ অভ্যাস থেকে নিজেকে দূরে রেখে পরম স্বর্গসুখের স্বাদ লাভ করা যায়।
পোষ্টটি ভাল লাগলে লাইক ও শেয়ার দিবেন।